প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরণের ভাইরাস আছে যা মানবদেহে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করতে পারে। তন্মধ্যে কতগুলো ভাইরাস সুনির্ধিষ্টভাবে মানবদেহের লিভার কোষকে আক্রমণ এবং তাতে প্রদাহ সৃষ্টি করে। এ কারণে এই ভাইরাসগুলোকে হেপাটাইটিস ভাইরাস বলা হয়। প্রধানত: যে ভাইরাসগুলো দিয়ে লিভারের প্রদাহ হয় সেগুলো হল- হেপাটাইটিস এ, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি হেপাটাইটিস ডি এবং হেপাটাইটিস ই ভাইরাস। তন্মধ্যে এ এবং ই ভাইরাস সাধারণত স্বল্প মেয়াদী লিভার প্রদাহ করে। বি ও সি ভাইরাস দীর্ঘ মেয়াদী লিভার প্রদাহ করে। হেপাটাইটিস ডি ভাইরাস পৃথকভাবে লিভার প্রদাহ করতে পারে না। ডি ভাইরাস বি ভাইরারেস আবরণে লিভারে প্রবেশ করে।
হেপাটাইটিস ভাইরাস কিভাবে ছড়ায়-
হেপাটাইটিস এ এবং ই দুষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে ছড়ায় এবং হেপাটাইটিস বি এবং সি ছড়ায় রক্তের মাধ্যমে। হেপাটাইটিস এ বা হেপাটাইটিস ই এর উত্স হলো রাস্তার পাশে ও ফুটপাতে বিক্রয়কৃত শরবত, ফলের রস এবং অন্যান্য পানীয়, রাস্তায় খোলা অবস্থায় বিক্রয়কৃত খাবার ও দৈনন্দিন রান্নার কাজে ব্যবহূত পানি যা ফুটানো হয়নি। বাংলাদেশে বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে বিভিন্ন জায়গায় খাবার পানি সংকট দেখা দেয় এবং এ সময় হেপাটাইটিস ই-এর মহামারী দেখা দেয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। অন্যদিকে, হেপাটাইটিস বি এবং সি ছড়ায় দূষিত রক্ত গ্রহণ, দূষিত সিরিঞ্জ ব্যবহার, নাপিত কর্তৃক ক্ষুরে দূষিত ব্লেড ব্যবহার, অপরিশোধিত যন্ত্রপাতি দিয়ে অস্ত্রোপচার, আক্রান্ত মা থেকে শিশুতে এবং অনিরাপদ যৌনমিলনের মাধ্যমে।
হেপাটাইটিসের বিরুদ্ধে মানবদেহের প্রতিরক্ষা এবং লিভার প্রদাহ-
হেপাটাইটিস ভাইরাস লিভারে প্রবেশ করলে মানবদেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ইন্টারফেরন নামক অণু। আক্রান্ত লিভার কোষ থেকে ভাইরাসকে দূর করতে কোষের চারিদিকে বিভিন্ন প্রকার শ্বেত রক্ত কণিকা জমা হয় এবং বিভিন্ন এনজাইম জাতীয় প্রোটিন নি:সরণ করতে থাকে। শারীরিক এ প্রক্রিয়াকে বলা ইয় ইনফ্লেমেশন বা প্রদাহ। প্রদাহের কারণে ভাইরাসের সাথে সাথে আক্রান্ত লিভার কোষও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ক্ষেত্রেবিশেষে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আমরা জানি, লিভারের ভিতর বিলিরুবিন নামক অণু প্রক্রিয়াজাত হয়। উক্ত অণু লিভার প্রদাহের সময় রক্তে বেরিয়ে আসে এবং রক্তের মাধ্যমে চোখ, জিহ্বা, ত্বক, রেচনতন্ত্র প্রভৃতি জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে লিভার প্রদাহে আক্রান্ত ব্যক্তির উপরোক্ত জায়গা এবং প্রস্রাব হলুদ হয়ে থাকে, মেডিক্যালের পরিভাষায় বলা হয় জন্ডিস। লিভার কোষে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম অ্যালানিন অ্যামাইনো ট্রান্সফারেজ এবং এসপারটেট অ্যামাইনো ট্রান্সফারেজ প্রদাহের কারণে রক্তে ছড়িয়ে পড়ে। প্রসঙ্গত, উক্ত এনজাইমদ্বয় যথাক্রমে এসজিপিটি এবং এসজিওটি নামেও পরিচিত। লিভার কতটুকু আক্রান্ত হল তা রক্তের বিলিরুবিন ও এনজাইমদ্বয় পরিমাপ করার মাধ্যমে বের করা যায়। আমরা জেনেছি, হেপাটাইটিস এ ও ই ভাইরাস স্বল্পমেয়াদী লিভার প্রদাহ করে। এই ভাইরাসদ্বয় লিভারে প্রবেশের পর খুব দ্রুতগতিতে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে এবং শরীরের প্রতিরক্সা ব্যবস্থাও খুব দ্রুত কাজ শুরু করে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে একজন আক্রান্ত ব্যক্তি পর্যাপ্ত বিশ্রাম পেলে এবং স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ করলে সাধারণত দুই সপ্তাহের মধ্যে কোন প্রকার ওষুধ ছাড়াই সুস্থ হয়ে উঠে।
অন্যদিকে, হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস লিভারে কোষে প্রবেশের পর নিরবে লিভার প্রদাহ করতে থাকে। লিভার কোষ আক্রান্ত হলেও প্রথম দিকে সাধারণত শরীরে কোন প্রকার লক্ষণ প্রকাশ পায়না। দীর্ঘ দিন প্রদাহের ফলে সৃষ্ট লিভার সিরোসিসের কারণে লিভার যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলে বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়। প্রাথমিক পর্যায়ে শরীরের উক্ত ভাইরাসদ্বয়ের বিপরীতেও ইনফ্লামেশন সৃষ্টি করে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তারা ভাইরাস দূর করতে সফলও হয়। হেপাটাইটিস বি ভাইরাস এবং হেপাটাইটিস সি দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর ১ থেকে ৪ মাসের মধ্যে ভাইরাস মুক্ত হতে পারে। তবে শরীরে এরা ৬ মাসের বেশি থেকে গেলে দীর্ঘ মেয়াদী রোগে পরিণত হয়েছে ধরা হয়। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত ৯০ শতাংশ নবজাতক, ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ শিশু যাদের বয়স এক থেকে পাঁচ বছর এবং ৬ থেকে ১০ শতাংশ ব্যক্তি যাদের বয়স পাঁচের উপরে দীর্ঘ মেয়াদী লিভার প্রদাহে আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত ১৫ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যক্তির লিভার প্রদাহ ১ থেকে ৩ মাসের মধ্যে ভালো হয়ে যেতে পারে।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস মানব লিভারে কোন প্রকার প্রদান না করেও দীর্ঘ মেয়াদে অবস্থান করতে পারে। একে বলে ক্যারিয়ার দশা। এছাড়া হেপাটাইটিস বি এবং সি উভয় ভাইরাসের কারণে লিভারে দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ হতে থাকলে লিভারের গাঠনিক পরিবর্ত চলে আসে এবং লিভারের কার্যক্ষমতা কমে যায়। এ অবস্থাকে বলে লিভার সিরোসিস। কোন কোন ক্ষেত্রে লিভার সিরোসিস থেকে লিভার ক্যান্সারও হতে পারে।
হেপাটাইটিস রোগের লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ-
একিউট ভাইরাল হেপাটাইটিস বা স্বল্পমেয়াদী লিভার প্রদাহের প্রধান লক্ষণগুলো হল-জন্ডিস, খাবার অরুচি, উপরের পেটের ডান দিকে বা মাঝখানে ব্যথা, বমি বমি ভাব বা বমি, দুর্বলতা ও জ্বর। লিভার প্রদাহের মাত্রা অনেক বেশি হলে গাঢ় জন্ডিস, পেটে পানি আসা ও চেতনালোপ জাতীয় লক্ষণ দেখা দেয়। অন্যদিকে ক্রনিক ভাইরাল হেপাটাইটিস তথা দীর্ঘমেয়াদী লিভার প্রদাহে সাধারণত: নির্দিষ্ট লক্ষণ থাকে না। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব ও পেটের ডানদিকের উপরিভাগে হালকা ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে। লিভার সিরোসিস হলে ক্ষুধামন্দা, পেটের অসুখ, শরীর শুকিয়ে যাওয়া, জন্ডিস, পেটে পানি আসা ও চেতনালোপ জাতীয় লক্ষণ দেখা দেয়। লিভার ক্যান্সার হলে শরীরের ওজন আশংকাজনকভাবে হ্রাস পায় এবং পেটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হয়। (চলবে)
0 Comments